Home ঘুরে আসি “শিব ঠাকুরের আপন দেশে”গাড়োয়াল হিমালয়ের বুকে কিছুদিন-প্রথম পর্ব

“শিব ঠাকুরের আপন দেশে”গাড়োয়াল হিমালয়ের বুকে কিছুদিন-প্রথম পর্ব

“শিব ঠাকুরের আপন দেশে”গাড়োয়াল হিমালয়ের বুকে কিছুদিন-প্রথম পর্ব

“মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের রক্তাক্ষয়ি সমর শেষ হওয়ার পরে আপন আত্মীয় সংহারের অনুশোচনা গ্রাস করে পাণ্ডব দের। ব্যাস মুনির পরামর্শে দেবাদিদেব শিবের আরাধনা শুরু করে তারা। ওদিকে মহাদেব নিজে কুরুক্ষেত্র মৃত্যু মিছিলে অত্যন্ত বিরক্ত ও বিসাদগ্রস্ত। মহাদেব ঠিক করলেন কিছুতেই পাণ্ডবদের দেখা দেবেন না। একটি ষাঁড় এর রূপ নিলেন আর গাড়োয়াল হিমালয় অঞ্চলে ঘুরে বেরাতে লাগলেন।ব্যাস মুনির নির্দেশে পাণ্ডবরাও হাজির হলেন সেখানে  কিন্তু মহাদেবের নাগাল পেলেন না কিছুতেই। পাণ্ডবরা জানতো ষাঁড় এর রূপ নিয়েছে শিব, কিন্তু হাজারটা ষাঁড় এর মধ্যে কোনটা শিব বোঝা দুষ্কর। ভীম এর উপর দায়িত্ব দেওয়া হোল মহাদেব কে খুঁজে বার করার। ষাঁড়দের চলার ফেরার পথে দু ধারের দুটো উঁচু পাথর এর উপর দাড়িয়ে পরে দ্বিতীয় পাণ্ডব, এমন ভাবে যে ষাঁড় এর দল কে তার পায়ের তোলা দিয়ে যেতেই হবে। সব ষাঁড় তার পায়ের তলা দিয়ে পার হয়ে গেলেও একটি ষাঁড় কিছুতেই সেই পথ এ আসতে চাইছে না। পাণ্ডবদের বুঝতে বাকি রইল না যে এই ষাঁড়টি শিব কারন ভগবান এর নশ্বর জীব এর পা এর তোলা দিয়ে যাওয়া টা বিধিসম্মত নয়। বোঝা মাত্র ভীম ধরে ফেলে ষাঁড় রুপি মহাদেব কে। কিন্তু মহাদেব তো দেবাদিদেব, উনি ই বা এত সহজে ধরা দেবেন? উনি পাতাল প্রবেশ করলেন। কিন্তু পাঁচ জায়গায় শিব এর দেহের কিছু কিছু অংশ মাটি র বাইরে বেরিয়ে আসে। তুঙ্গনাথ এ বাহু, কেদারনাথ এ কুঁজ, রুদ্রনাথ এ মাথা, মদ মহেশ্বর এ নাভি ও পেট আর কল্পেশ্বর এ জটা। শিব কে তুষ্ট করতে সেই পাঁচ জায়গায় পাণ্ডব রা শিব এর মন্দির তৈরি করে পুজা নিবেদন করে।“

তারিয়ে তারিয়ে একটানা গল্প বলে একটু থামল লাখপাত সিং নেগি। সারী গ্রাম এর বাসিন্দা নেগি আমাদের তাবু, থাকার জায়গা আর খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব ভার নিয়েছে। আমরা যারা ট্রেক করতে এসেছি পুরান এর গল্পের থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আগ্রহ অনেক বেশি। আমরা গাড়োয়াল হিমালয় এর রথি মহারথি দের চাক্ষুষ করতে মুখিয়ে আছি। চৌখাম্বা, ত্রিশূল, কেদারনাথ, নান্দাদেবি, থালেসাগর, নান্দা ঘুন্তি কখন দেখব সেই চিন্তায় বিভোর। কিন্তু সারী গ্রাম এর এই হার কাঁপানো শীত এ লাখপাত নেগি র গল্প শুনতে মন্দ লাগছে না।


“ আপ লোগ দেবভুমি মে আয়ে হো স্যার জী। ইহা হার পাথথরমে শিব জি বস্তে হ্যায়।“ নেগির ইস্তাহার।
“ কাল কিতনে বাজে নিকাল না হ্যায় নেগি জি?” নেগির উতসাহে জল ঢালল স্থিথধী। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে নাস্তিক।
“সুবাহ সারী গাও ঘুম লিজিয়ে। ফির নাস্তা করকে নিকাল জাইয়েগা” ব্যাজার মুখ নেগির।


হরিদ্বার থেকে গাড়িতে প্রায় ৯ ঘণ্টা লেগেছে সারী গ্রাম পৌছতে। পথে দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ এ নেমে ছবি তুলে টুলে একটু সময় নষ্ট হয়েছিল। সবাই ক্লান্ত। ঠাণ্ডা টাও জাঁকিয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে চাইছে সবাই। আমরা দলে ৬ জন আছি। আমি, দিব্যেন্দু, স্থিথধি, কুনাল, সন্দিপ আর দেবরঞ্জন। নেগির জন্য কলকাতা থেকে আনা নরম পাকের সন্দেশ ওকে দিয়ে, আমরা উদরপূর্তি করে ঘুমোতে গেলাম।

কাল আমাদের হাল্কা ট্রেক। সারে ৩ কিমি. মতন। গন্তব্য “দেওরিয়াতাল” বা দেবতাদের হ্রদ। হ্রদ নিয়েও মহাভারত এর গল্প নেগি করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। পাণ্ডবদের অজ্ঞ্যাতবাসের সময় তৃষ্ণার্ত পাণ্ডব রা যখন যক্ষের পাহারা দেওয়া হ্রদ এর জল পান করে একে একে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে তখন যুধিষ্ঠির যক্ষের সব হেঁয়ালির সঠিক উত্তর দিয়ে ভাই দের প্রান ফেরান।দেওরিয়াতাল নাকি সেই হ্রদ। যাই হোক চৌখাম্বার প্রতিবিম্ব দেওরিয়াতাল এ উপর একটা নৈসর্গিক দৃশ্যর সৃষ্টি করে। আমাদের আগ্রহ সেই দিকে।


পাহাড় এ এলেই দেখেছি আমার একটা আমুল পরিবর্তন দেখা দেয়। যে আমি ৮টার আগে বিছানা ছাড়ি না, পাহাড়ে এলে সেই আমি সবার আগে এবং বেশির ভাগ সময় সূর্যোদয় এর আগে উঠে পরি। আজও তাই হোল। ক্যামেরা হাতে হাঁটতে বেরলাম। নেগির গেস্ট হাউস একদম উখিমঠ চোপতা হাইওয়ে র উপর। গেস্ট হাউস এর গা বেয়ে হাঁটা পথ উঠে গেছে দেওরিয়াতাল এর দিকে। আর রাস্তা টোপকে ঢাল এর গা বেয়ে ছড়িয়ে আছে ছবির মত সুন্দর সারী গ্রাম। গ্রাম এর বাড়িগুলো পাথর এর তৈরি। ছাদ টাও পাথর এর পাতলা টালি দিয়ে ছাওয়া।সবচেয়ে অভিনব হোল কাঠের কারুকার্য করা দরজা আর জানলা। গ্রাম এর অধিকাংশ বাড়ি পাণ্ডববর্জিত। নেগি পরে বলেছিল অনেকেই শহর এ চলে গেছে চাকরি বাকরি র খোজ এ। যারা আছে তারা চাষ বাস করে আরে ট্রেক এর দল এলে গাইড এর কাজ। একটা দুটো বাড়ি আবার দোতলা। বোঝা গেলো এরা গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবার। গ্রাম এ একটা প্রাইমারি স্কুল ও আছে।


জলখাবার খেয়ে আমরা আমাদের ট্রেক শুরু করার জন্য তৈরি। বাকিরাও ইতিমধ্যে সারী গ্রাম ঘুরে নিয়েছে। নেগির মেজাজ ফুরফুরে এখন। নরম পাঁক এ কাজ হয়েছে। নেগির কথা অনুযায়ী একটাই পথ খাঁড়াই উঠে গেছে তাল পর্যন্ত। গাইডের কোনও প্রয়োজন হবে না। ওপরে তাল এর ঠিক আগে একটা চা জলখাবার এর অস্থায়ী দোকান আছে। ওখানে গিয়ে নেগি পাঠিয়েছে বললেই হবে। ওরাই তাবু আর খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দেবে। অনেকে দেওরিয়াতাল থেকে নেমে এসে গাড়ি তে চেপে চোপতা যায়। জঙ্গল এর মধ্যে দিয়ে ১৬ কিমি. ট্রেক রুট আছে। সেটা দিয়ে আমরা যাব। নেগিকে বলতে রে রে করে উঠল।


“ ওয়হ তো ফরেস্ট এরিয়া হ্যায়। পারমিশান লাগেগা। গাইড লাগেগা। আকেলে ভাটাক জাওগে। লেপার্ড, ভালু হ্যায় জঙ্গাল মে।“
“ তো আপ এরেঞ্জ কিজিয়ে না। হাম উস রাস্তে সে হি জায়েঙ্গে” দিব্যেন্দু জানিয়ে দিল।

আগামী শনিবার দ্বিতীয় পর্ব