web Desk: একবিংশ শতকের ফেসবুকের দুনিয়াতে দাঁড়িয়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কম কনডম ব্যবহারের ফলেই গনোরিয়া রোগ ছড়িয়ে পড়ছে এবং ‘ওরাল সেক্স’ এর জন্য গনোরিয়ার জীবাণুরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। সংস্থার তরফ থেকে আরও বলা হয়, এই পরিস্থিতিতে কোনও ব্যক্তি গনোরিয়ায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করার বিষয়টি সমস্যার হয়ে উঠছে ও কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা ‘অসম্ভব’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, যৌন সংসর্গের মাধ্যমে ছড়ানো এই রোগের জীবাণু অ্যান্টোবায়োটিকের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করছে। তাই অ্যান্টোবায়োটিক শরীরে কাজ করছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন কার্যকরী অ্যান্টোবায়োটিক উদ্ভাবন করা যায়নি, তাই এই রোগে আক্রান্ত হলে অবস্থা খারাপের দিকেই এগোচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুসারে দেখা গেছে বিশ্বে প্রায় সাত কোটি আশি লাখ মানুষ প্রতি বছর এই রোগ সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন, যা অনেকের ক্ষেত্রেই সন্তান জন্মদানে ক্ষেত্রে অক্ষমতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সংস্থার তরফ থেকে বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, গনোরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠার প্রবণতা কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
এই সংস্থাটির বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তিওডোরা উয়ি বলেছেন, জাপান, ফ্রান্স ও স্পেনে অন্তত তিনটি ঘটনা পাওয়া গেছে যেখানে গনোরিয়া পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয়।
তিওডোরা উয়ি বলেছেন “গনোরিয়ার জীবাণুকে খুবই স্মার্ট বলতে হবে। যতবার আপনি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এর চিকিৎসা করতে চাইবেন, ততবারই তা প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করবে।”
সবথেকে বেশি চিন্তার বিষয় হলো, গরিব দেশগুলোতে গনোরিয়া সংক্রমণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে; যেখানে এই জীবাণু কতটা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে, সেই তথ্য পাওয়া কঠিন।
গলায় সংক্রমণ
বিজ্ঞান মতে গনোরিয়ার জীবাণু সাধারণত যৌনাঙ্গ, মলদ্বার বা গলার ভেতরে সংক্রমণ ঘটায়। তবে এর মধ্যে গলার সংক্রমণই চিকিৎসকদের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডা: উয়ি বলছেন, “সাধারণ গলাব্যথার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলেও তাতে নেইসেরিয়া প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, আর ‘ওরাল সেক্স’ এর মাধ্যমে যদি গনোরিয়ার ব্যাকটেরিয়া অর্থাৎ নেইসেরিয়া গনোরিয়া ওই পরিবেশ পায় তাহলে তা ‘সুপার গনোরিয়া’ তৈরি করতে পারে।”
তিনি আরও যোগ করেন “যুক্তরাষ্ট্রে সমকামী পুরুষদের মধ্যে গলবিলের (ফ্যারিংক্স) সংক্রমণের মাধ্যমে গনোরিয়া জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।”
কনডোম ছাড়া যৌন সম্পর্কে জড়ানোর কারণে এইচআইভি এইডস রোগ ছড়োনোর যেমন আশঙ্কা আছে তেমনি একই কারণে গনোরিয়া সংক্রমণের শঙ্কাও রয়েছে।
গনোরিয়া কী?
নেইসেরিয়া গনোরিয়া নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই রোগটি হয়। সুরক্ষা ছাড়া যৌন সম্পর্ক বা ওরাল ও অ্যানাল সেক্সের কারণে গনোরিয়া ছড়িয়ে যেতে পারে।
এই রোগটির লক্ষণগুলো হলো- যৌনাঙ্গ থেকে হলুদ বা সবুজ রঙের পুঁজের মতো বের হতে পারে, প্রস্রাবের সময় জ্বালা করতে পারে বা প্রস্রাব বন্ধও হয়ে যেতে পারে৷ নারীদের তলপেটে ব্যথা ও ঋতুস্রাবে জটিলতাও দেখা দিতে পারে। যদিও এই রোগে আক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে একজন ও নারীদের তিন চতুর্থাংশ এবং সমকামী পুরুষদের ক্ষেত্রে এ রোগের লক্ষণ সহজে শনাক্ত করা যায় না। আর এই রোগ যদি না সারে তাহলে তা বন্ধ্যাত্বের কারণও হতে পারে। গর্ভাবস্থায় এই রোগ সংক্রমণের শিকার হলে তা শিশুর শরীরেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংস্থার তরফ থেকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র তরফ থেকে বলা হয়েছে, গনোরিয়া রোগটি আরও বিপদজ্জনক হয়ে ওঠা ঠেকানোর জন্য প্রতিটি দেশে পর্যবেক্ষণ জোরদার করা ছাড়াও নতুন ওষুধ তৈরির গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ‘ওরাল সেক্স’ গনোরিয়ার জীবাণুকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ভয়ঙ্কর মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে।
গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপের কর্মকর্তা ডাক্তার মনিকা বালাসেগারাম বলছেন, “পরিস্থিতি গুরুতর, মাত্র তিনটি ওষুধ গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। সেগুলি কার্যকরী প্রমাণিত হবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই।”
তবু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে গনোরিয়া ঠেকাতে নতুন ওষুধ তৈরি করতেই হবে। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক রিচার্ড স্ট্যাবলার বলছেন, “গনোরিয়ার জীবাণু নতুন অ্যান্টিবায়োটিকেও এত বেশি প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে যে গত ১৫ বছরে তিন দফায় চিকিৎসা পদ্ধতি বদলাতে বাধ্য হয়েছে চিকিৎসকেরা, এখন আমরা যে ওষুধ ব্যবহার করছি এটাই আমাদের শেষ ভরসা। উদ্বেগের বিষয় হল, সেই চিকিৎসাও ব্যর্থ হওয়ার তথ্য আমরা পাচ্ছি।”
‘ওরাল সেক্স’ কি এখন সাধারণ কোনো বিষয় হয়ে উঠেছে?
এখন আগের তুলনায় বিশ্বের মানুষ ‘ওরাল সেক্স’ – এ বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় কারণ এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য বৈশ্বিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে বুঝা যাচ্ছে যে দুই দেশেই এটা খুবই সাধারণ একটা বিষয়। বছরের পর বছর ধরে এমনটা হয়ে আসছে, এমনকি টিন-এজাররাও ‘ওরাল সেক্স’ করছে।
১৯৯০-৯১ সালে যুক্তরাজ্যের মানুষের ‘সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার ও লাইফস্টাইল’ নিয়ে জাতীয় সমীক্ষা করা হয়েছিল। সেই সমীক্ষায় দেখা যায় ৬৯.৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৫.৬ শতাংশ নারী প্রতি বছর তার বিপরীত লিঙ্গে কাছ থেকে ‘ওরাল সেক্স’ গ্রহণ করে বা দেয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সমীক্ষায় গবেষকরা দেখেছেন, ১৫-২৪ বছর বয়সীদের দুই-তৃতীয়াংশই ‘ওরাল সেক্স’ এ অভ্যস্ত। তাই চিন্তার কারণ রয়েই যায়….