ওয়েব ডেস্কঃ আমরা জানি ভারতীয় ইতিহাসে বদ্রীনাথ ধাম, দ্বারকা, জগন্নাথ পুরী আর রামেশ্বরম ধামকে চারধাম হিসাবে বর্ণনা করা হয়। আজ আমি আপনাকে রামেশ্বরম ধামের অদ্ভুত রহস্যর কথা বলব যার জন্য আপনার জীবনকালে অবশ্যই আপনি রামেশ্বরধাম দর্শন করার কথা চিন্তা করবেন। এটি হিন্দুদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান যা তামিলনাড়ুর রামনাথপুরম জেলায় অবস্থিত। এখানে স্থাপিত শিবলিঙ্গ বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের একটি বলে মানা হয়। ভারতের উত্তরে কাশীর যে ধর্মীয় প্রভাব, দক্ষিণে রামেশ্বরমেরও সেই একই প্রভাব। এটি চেন্নাই থেকে ৪২৫ কিমি দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত। উপরের দিক থেকে দেখলে এটি হিন্দু মহাসাগর আর বঙ্গোপসাগর দ্বারা চারদিক দিয়ে ঘেরা একটি শঙ্খ আকৃতির দ্বীপ। বহু আগে এটি ভারতের মুখ্য ভূমির সাথে একত্রিত ছিল। কিন্তু সাগর এর চারদিকে আস্তে আস্তে নিজের প্রভাব বিস্তার করে এক মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
ভগবান রামচন্দ্র এখানে লঙ্কা যাবার পূর্বে এক পাথরের সেতু নির্মাণ করেছিলেন যার দ্বারা বানর সেনা লঙ্কা পৌঁছে বিজয় প্রাপ্ত হয়। পরে বিভীষণের অনুরোধে রামচন্দ্র ধনুষকোটি নামের একটি জায়গায় এই সেতুটি ভেঙে দিয়েছিলেন। আজও ত্রিশ মাইল লম্বা এই সেতুটির ভগ্নাংশ সাগরে দেখা যায়। রামেশ্বরম এর মন্দির ভারতীয় শিল্পকলা ও সংস্কৃতির এক অদ্ভুত নমুনা বহন করছে। এর প্রবেশ দ্বার লক্ষ্য করলে দেখা যায় এটি চল্লিশ ফুট উচ্চ এবং রামনাথয়ের চারদিকে পরিক্রমা করার জন্য তিনটি প্রাকার নির্মিত। এর মধ্যে তৃতীয় প্রাকারটি একশত বছর আগে নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এই প্রাকারটি চারশো ফুটেরও অধিক লম্বা ও পাঁচ ফুট সুউচ্চ। একদিকে পাথর নির্মিত লম্বা থাম রয়েছে। এই প্রাকার আর মন্দিরটির মধ্যে এরকম কয়েকশো বিশাল থাম রয়েছে যেগুলি দেখতে সবকটি একই ধরণের প্রায়। কিন্তু প্রতিটি থামের উপরে অঙ্কিত চিত্রগুলি প্রতিটি একটির থেকে আরেকটি আলাদা এবং দেশবিদেশের পর্যটকরা এগুলির নির্মাণ শৈলি ও সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে যায়।
সবথেকে অবাক করার বিষয়টি হল এখানে এই মন্দিরের আশেপাশে বা দূরবর্তী কোন পাহাড় নেই যেখান থেকে পাথর সহজেই এখানে নিয়ে আসা যায়। গন্ধমাদন পর্বত আসলে নামমাত্র একটি পর্বত। আসলে ওটি একটি টিলা আর প্রয়োজনীয় পাথরের সংস্থানের জন্য যথেষ্ট নয়। এরকম মানা হয় যে এখানে যে কয়েক লক্ষ টন পাথরের ব্যবহার, তা বহু দূর থেকে নৌকা করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।রামনাথপুরমে একটি কালো পাথর রাখা রয়েছে যা মনে করা হয় রামচন্দ্র কেবটরাজাকে তাঁর রধাজতিলকের সময় চিহ্ন হিসাবে দিয়েছিলেন। রামেশ্বরমে যাত্রীগণ যাবার আগে এই কালো পাথরটি দেখার জন্য রামনাথপুরমে যান। রামনাথপুরম, রামেশ্বরম থেকে ৩৩ মাইল দূরে অবস্থিত।
এবার রামেশ্বরম ধামের স্থাপনের বিষয় কিছু কথা বলি।যখন শ্রী রাম রাবণের বধ করার পরে বিজয়ী হয়ে অযোধ্যা ফিরছিলেন, তখন তিনি সমুদ্রের এই পারে গন্ধমাদন পর্বতে থেমে প্রথম বিশ্রাম করেছিলেন। তাঁর সাথে সীতাদেবী এবং অন্যান্যরাও ছিলেন। তাঁর আগমনের খবর পেয়ে বিভিন্ন ঋষিমুনিরা তাঁর দর্শনের জন্য ওখানে পৌঁছেছিলেন। তখন রামচন্দ্র তাঁদের বলেন যে তাঁর উপর ব্রক্ষ হত্যার পাপ লেগেছে এবং এই ব্রক্ষহত্যার পাপ থেকে মুক্তির উপায় কী। তখন সব ঋষিরা তাঁকে এই পরামর্শ দেন যে তিনি যদি কোন শিবলিঙ্গ স্থাপন করে তার পুজো করেন তাহলে তাঁর সকল পাপমুক্তি হবে। মুনিঋষিদের থেকে এই বিসয় জানার পরে তিনি মহাবীর হনুমানকে বলেন কৈলাস পর্বতে গমন করে সেখান থেকে শিবলিঙ্গ নিয়ে আসতে। কিন্তু হনুমান সেখানে শিবের দর্শন না পেয়ে শিবের তপস্যা করতে থাকেন। সেখানে হনুমানের তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে শিব তাঁকে দর্শন দেন এবং শিবলিঙ্গ পেয়ে হনুমান পুনরায় গন্ধমাদন পর্বতে পৌঁছে যান।
এই ঘটনায় প্রচুর সময় ব্যয়িত হয় এবং সঠিক সময়ের মধ্যে লিঙ্গস্থাপন না হবার আশঙ্কায় সকল মুনিঋষিগণ রামচন্দ্রের কাছে শিবলিঙ্গ স্থাপনের জন্য যত শীঘ্র সম্ভব অনুরোধ করেন।তখন সীতাদেবী বালুকা দ্বারা লিঙ্গ তৈরী করে বিধিসম্মত ভাবে তাই স্থাপন করে দিলেন। মহাবীর হনুমান তাঁর ফিরে আসার পূর্বেই লিঙ্গস্থাপনের ঘটনায় অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে পরেন এবং তখন শ্রী রামচন্দ্র তখন অত্যন্ত স্নেহভরে তাঁকে লিঙ্গস্থাপনের কারণ বর্ণনা করেন। তবুও মহাবীর সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট না হওয়ায় রামচন্দ্র তাঁকে বলেন বালুকা নির্মিত লিঙ্গটি তুলে ফেলে দিতে যাতে সেখানে তাঁর আনা পাথরের লিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করা যায়।
শ্রী রামচন্দ্রের কথায় মহাবীর ওই লিঙ্গটি তুলে ফেলার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেন কিন্তু লিঙ্গটির থেকে নিজেই ধাক্কা খেয়ে তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে পরেন এবং মূর্ছা যান। বহুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে তিনি স্বয়ং রামচন্দ্রকে সামনে পান এবং তাঁর মধ্যে পরম ব্রক্ষকে দর্শন করেন। মহাবীরের খুব আত্মগ্লানি হয় আর অনুশোচনায় তিনি শ্রী রামের চরণাশ্রিত হন। তিনি ভাববিহ্বল হয়ে শ্রী রামের স্তূতি করেন আর ভগবান রামচন্দ্র তাঁকে বোঝান যে নিজের কর্মফলের জন্য তাঁকে এত কষ্ট পেতে হল।
শ্রী রামচন্দ্র বলেন যে তাঁর দ্বারা স্থাপিত ওই লিঙ্গটি দুনিয়ার কোন শক্তি তুলে ফেলতে পারবে না।হনুমান আনা কৈলাস থেকে শিবলিঙ্গটিকেওও ওখানেই রামচন্দ্র স্থাপন করেন এবং তার নাম রারাখেন হনুমতেশ্বর।যার জন্য হনুমান অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। এটি আগে একটি ছোট ঝুপড়ির মধ্যে একজন সাধুর দেখভালে ছিল কিন্তু পরে বারোশ শতাব্দীতে শ্রী রামনাথস্বামী, শ্রী বিসলকোষ চারদিকে গর্ভগৃহের নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে স্তাপিত লিঙ্গটি স্বয়ং ভগবান দ্বারা স্থাপিত বলে মনে করা হয়। এটি কোন সাধারণ মন্দির নয়। বরং ধর্ম আর আস্থার এক অসাধারণ মেলবন্ধন বলে মনে করা হয়। প্রতিবছর অগণিত মানুষ এই মন্দির দর্শনে আসেন। কথিত আছে যে ভক্ত গঙ্গাজল দ্বারা এই লিঙ্গ স্নান করাতে পারেন তিনি জীবনমৃত্যুর কালচক্র থেকে মুক্ত হয়ে যান আর পরম মোক্ষপ্রাপ্তি হয়।