শুক্রবার শেষ হল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ যাত্রা। কাকদ্বীপে জনসভার মাধ্যমে এই যাত্রার সমাপ্তি। ২৫ এপ্রিল থেকে ১৬ জুন। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ। প্রায় ৪৫ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছেন অভিষেক। পথে বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করে থেকেছেন। মিছিল করেছেন। জনসংযোগ করেছেন। দলীয় কর্মীদের ধমকেছেন। পথনির্দেশ দিয়েছেন। আবার যাত্রা স্থগিত রেখে সিবিআই ডাকে কলকাতায় এসে সাড়ে ন’ঘণ্টা জেরার মুখোমুখি হয়েছেন। প্রশ্ন হল, প্রায় দু’মাসব্যাপী এই যাত্রায় কাঙ্খিত সাফল্য কি তিনি পেলেন?
এই যাত্রার লক্ষ্য কী ছিল? নিবিড় জনসংযোগ। সাংগঠনিক দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠা। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। এর সঙ্গে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ‘বঞ্চনার’ যে অভিযোগ, তাকে মানুষের কাছে তুলে ধরা।
এমন একটা সময় এই যাত্রা শুরু করলেন অভিষেক, যখন চারপাশে অন্যতম আলোচ্য বিষয় হল শিক্ষায় নিয়োগ, গরুপাচার, কয়লাপাচারের মতো দুর্নীতি। যে দুর্নীতিতে জেলে দলের মহাসচিব। জেলে বীরভূমের ‘দাপুটে নেতা’ অনুব্রত মণ্ডল। এই দুর্নীতির সুতো ধরে টান দিতেই বেরিয়ে পড়ছে একের পর নেতার নাম। এই অবস্থায় সামনেই দুটো ভোট। পঞ্চায়েত ও লোকসভা। এসবের প্রভাব যে ভোট পড়বে তা বলাই বাহুল্য। এই অবস্থায় দলের মনোবল চাঙ্গা করতে কর্মসূচির প্রয়োজন ছিল। সেদিক থেকে দেখলে সঠিক সময় সঠিক পদক্ষেপ।
রাজনৈতিক মহলের কেউ কেউ বলছেন, তৃণমূলের আগামী নেতার স্থানান্তরপর্বে মমতা অভিষেককে পরিচয় করিয়ে দিতে চান নিজের মতো করে। তিনি যেমন আম জনতার ঘরে ঢুকে যান। চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খান, এমন কি কখনও কখনও নিজে চা বানান। এই জনসংযোগ যাত্রায় অভিষেককে দেখা গিয়েছে সেই ভাবে। তিনি চা দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছেন। মিছিল করতে করতে সাধারণ মানুষের ঘরের অন্দরে ঢুকে গিয়েছেন, তাঁদের অভাব-অভিযোগ শুনেছেন। কেন কাজ হচ্ছে না তা স্থানীয় তৃণমূল কাছে জানতে চেয়েছেন। ধমক দিয়েছেন। এক কথায় এই যাত্রায় অভিষেককে অনেকটাই মমতার প্রতিরূপ হিসাবে দেখা গিয়েছে। এই যাত্রায় শেষতম সংযোজন ছিল রক্তদান শিবিরে গিয়ে রক দেওয়া।
নবজোয়ার যাত্রার সমাপ্তিতে কাকদ্বীপের জনসভায় তৃণমূল দলনেত্রী একটি ছবি দেখান। যে ছবিতে শিশু অভিষেককে কোল নিয়ে রয়েছেন তাঁ মা গায়েত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ছবি দেখিয়ে মমতা জানান, মাত্র দু’বয়স থেকে রাজনীতি করছে অভিষেক। অর্থাৎ বিরোধীরা যে ‘পরিবারতন্ত্র’-এর অভিযোগ তোলে এই ছবি দেখিয়ে তার জবাব দিতে চেয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। যদিও এই রাজনীতি করার বয়স নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
অভিষেকের ছোটবেলার ছবি দেখাচ্ছেন মমতা।
তাঁর এই যাত্রায় একটি অন্যতম কর্মসূচি ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী বাছা। ব্যালটের মাধ্যমে চলেছে সেই প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া। তাকে কেন্দ্র করে অশান্তিও হয়েছে। বিরোধীরা কটাক্ষ করেছেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ বলে।
এই যাত্রাকে কেন্দ্র করে খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ তুলেছেন, রাজনৈতিক দলে যাত্রায় পুলিশি নিরাপত্তার ‘বাড়বাড়ন্ত’ নিয়ে। এই সফরে জঙ্গলমহলে কুর্মিদের বাধার মুখেও পড়েছেন অভিষেক।
প্রশ্ন হল এই যাত্রায় কাঙ্খিত সাফল্য কি তিনি পেলেন? মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘সাত মন তেল পুড়লেও রাধা নাচল না।’ বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘জনতার ক্ষোভ। দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটাতে এই যাত্রা। দুর্নীতির খবর থেকে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি ঘোরানোর চিত্রনাট্য।’
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘নবজোয়ার যাত্রা’ কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারল কি না, সাফল্য এল কি না, তা সময় বলবে। তবে এই যাত্রায় যে অভিষেক অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন তা বলাই বাহুল্য। রাজ্যাভিষেকের আগে ‘যুবরাজ’কে কী জনতার দরবার থেকে ঘুরিয়ে আনলেন দলেনেত্রী? দলের অন্দরে সেটা বলছেন অনেকে।