পথ —— ৪৪
——————
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
একটা সময় প্রতি স্কুলেই একজন করে পণ্ডিতমশাই থাকতেন। বয়স পঞ্চাশের ওপর।
যেমন আজও অনেক স্কুলেই দারোয়ান বলতে একজন নেপালি থাকবেই আর তার নাম অবশ্যই
হবে বাহাদুর। আসলে নেপালি দারোয়ান মানেই বাহাদুর। এটা কোনো নাম নয়। যেমন
পণ্ডিতমশাই কোনো নাম নয়। এটা তাঁকে চিনে নেওয়ার উপায়। উনি স্কুলে সংস্কৃত
পড়াবেন।
আমাদের স্কুলেও একজন পণ্ডিতমশাই ছিলেন। তাঁর নাম আজ আর মনে নেই। আমরা
তাঁকে পণ্ডিতবাবু বলতাম। ওনার একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল। এমনভাবে হাঁটতেন যে
দেখে মনে হতো উনি যেন আর শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারছেন না। আমাদের অনুমান
যে ভুল ছিল না উনি ক্লাসে এসে ঢোকার পরই সেটা বোঝা যেত। চেয়ারের ওপর বাবু হয়ে
বসে ডানহাত দিয়ে বামপা-টায় হাত বুলোতেন। কুঁজো হয়ে বসতেন। যতক্ষণ ক্লাসে
থাকতেন একবারের জন্যও চেয়ার ছেড়ে উঠতেন না। চেয়ারে বসেই যাকে যা নির্দেশ
দেওয়ার দিতেন।
এই পণ্ডিতবাবু যদি একবার কোনো ছাত্রকে দেখতেন সে মুখে আঙুল দিচ্ছে তাহলে
আর দেখতে হবে না, সাথে সাথে তাকে ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতেন।
কারও কারও কাছে এই শাস্তি ছিল আশীর্বাদের মতো। কারণ উনি ক্লাসে এসে শব্দরূপ
ধাতুরূপ ধরবেনই। আর বলতে না পারলে তাঁকে সারা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তার
চেয়ে এইরকম মুখে হাত দিয়ে ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া অনেক আনন্দের।
আমিও বেশ কয়েকবার এরকম ইচ্ছা করে মুখে হাত দিয়ে ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে
গেছি। পড়া বলার হাত থেকে মুক্তিই এর একমাত্র কারণ নয়। আমার কাছে এর আরও একটা
কারণ ছিল। স্কুলের চৌহদ্দি যখন চুপচাপ তখন স্কুলঘরের বাইরে বেরিয়ে তা অনুভব
করার মধ্যে আমি দারুণ একটা আনন্দ খুঁজে পেতাম।
আমার তখন ক্লাস এইট। ওই পদ্ধতিতেই একদিন ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি। কিছুটা নেমে বামদিকের দেওয়ালে একটা গর্ত থাকত।
সিঁড়ি দিয়ে যেই নামুক না কেন দেওয়ালের ওই গর্তের দিকে তার নজর যাবেই। ঘরটা
ছিল গ্রাউন্ড ফ্লোরে ক্লাস টেনের ঘর। সেদিন আমিও তাকিয়েছি। ওই ঘরের
মাস্টারমশাই-এর সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেছে। আমার ভাগ্য খুবই খারাপ। সেদিন
ওই ঘরে অঙ্কের ক্লাস নিচ্ছিলেন অজিতবাবু। যাকে আমরা যমের থেকেও বেশি ভয়
পেতাম।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেই গেট দিয়ে বেরোতে যাব দেখি অজিতবাবু আমার চোখের
সামনে। আমাকে ডাকছেন। আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম এটা ঘটবেই। বরং কিছু না
হওয়াটাই অস্বাভাবিক ছিল। আমাকে টেনের ক্লাসে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমার তো ভয়ে
হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সেই সঙ্গে লজ্জাও। কারণ ক্লাস টেন আমার
কাকা জ্যেঠার ছেলে আর তাদের বন্ধুতে ভরা। তাদের চোখের সামনে কিছু হওয়া মানে
পরেও আমাকে এর ফল ভোগ করতে হবে। কারণ ওরা আমাকে রাগাবে।
অজিতবাবু প্রথমে এমন আচরণ করলেন যে মনে হল এযাত্রায় আমি বেঁচে গেলাম।
ক্লাসঘরের ভেতরে ঢুকতেই উনি সমস্ত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, ” এ তোমাদের একটা
ছোট ভাই। এর অঙ্কে এতই প্রতিভা যে এর ক্লাসের অঙ্ক ওর যথেষ্ট নয়, তাই লুকিয়ে
লুকিয়ে আমার ক্লাস দেখছে। আমরা তাহলে ওকে একটা সুযোগ দিই। ” উনি আমাকে নিয়ে
গিয়ে একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন। আর কোনো কথা না বলে আবার অঙ্ক করাতে শুরু করে
দিলেন। কিছুক্ষণ অঙ্ক কষে হঠাৎ থেমে গিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন। যথারীতি আমি
উত্তর দিতে পারলাম না। কারণ অঙ্ক আমার কাছে একটা আতঙ্কের বিষয় ছিল। তারপরেই
শুরু হল মার।
আজও আমি এই শাস্তিটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারি না। একটা ক্লাস এইটের
ছেলে, তার মনে কৌতূহল থাকতেই পারে। তাকে না মেরে বোঝানো তো যেতেই পারতো। এই
সামান্য ব্যাপারটা তখনকার অনেক শিক্ষকই জানতেন না। শিক্ষক মানে তাঁরা মনে মনে
নিজেদের এই ভাবনাকেই প্রশ্রয় দিতেন —– ছাত্রদের কাছে তাঁরা আতঙ্ক হয়েই
থাকবেন। শিক্ষক মানেই শুধু শাসন। অজিতবাবুর মনেও নিশ্চয়ই একরকম কোনো ভাবনা
উঁকি দিত। কারণ আমি তাঁকে কখনও হাসতে দেখি নি।
******************************