ওয়েব ডেস্কঃ বইপাড়া মানেই কলেজ স্ট্রিটে যেতে হয়। কখনও কাজে, কখনও আড্ডা দিতে। বাঙালির কলকাতা ডায়েরিজে যেমন কফি হাউজের মান্না দে জড়িয়ে গেছে তেমন নাম কিন্তু রয়েছে শতবর্ষের বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের প্যারামাউন্ট হল ঐতিহাসিক এক শরবতের দোকান। আসলে শরবত নয়, দোকানটি নস্টালজিয়ার জন্য এক অনন্য স্থান। নাম ও দোকানের সুস্বাদু মিষ্টতা আগলে রেখেছে একশো বছরের ইতিহাস।
শরবত সকলেই খান, এই দোকানে বিখ্যাত মানুষের শরবত খাওয়ার তালিকাটি সত্যই দীর্ঘ। কারণ দোকানটি তো এখন যৌবনের ঘোড়ার মতো ছুঁটছে। বিপ্লবী, বিজ্ঞানী, কবি, অভিনেতা সকলেই এসেছেন যে। নাম তো সকলের অজানা নয়—বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, অমর্ত্য সেন, উত্তম কুমার প্রমুখ। ১৯১৮ সাল থেকে ব্যাটিং করে চলেছে তার সেই স্বাদ ও সেই গন্ধ নিয়ে।
অজানা কিছু কথা….
বরিশালের কাঁচাবেড়িয়া গ্রামে ছিল নীরাঞ্জন মজুমদারের বাসস্থান। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, বরিশাল অনুশীলন সমিতির সদস্য। সমিতির কাজ যাতে ঠিকমতো করা যায় তাই তিনি ডেরা বাঁধেন এই কলকাতায়। সমিতির সদস্যরা তাঁর ডেরায় এসেই গোপনে সভা করতেন। সদস্যদের মধ্যে আছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পুলিনবিহারি দাস, সত্যেন সেন প্রমুখ। এখানে টিকটিকিদের নজর এড়িয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও আসতেন। আসল ঘটনাটি হল ব্রিটিশ টিকটিকি আর পুলিশকে ফাঁকি দিতেই মুখের ওপর নীরাঞ্জনবাবু খুলে বসেন এই শরবতের দোকান। সেই ক্যালেন্ডারের সালটি হল ১৯১৮। দোকানের নাম রাখেন ‘প্যারামাউন্ট শরবত’। ভাল জিনিস মানুষ চেনে। সুখ্যাতি ছড়াতে বেশি দিন লাগেনি। তাই এই বিপ্লবী নীরাঞ্জনবাবুকে তারপর থেকে বেশি লোক শরবতওয়ালা নামেই চিনে নেন। নীরাঞ্জনবাবু মারা যাওয়ার পরে তাঁর দুই ছেলে পরিমল মজুমদার ও দিলীপ মজুমদার দোকানের হাল ধরেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই মানুষের জন্য সেবা দিয়ে আসছেন। যদিও তাঁদের এটাই রুটিরুজি তবু তারা একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এখন দায়িত্বের মশাল উঠেছে পরিমল মজুমদারের ছেলে পার্থপ্রতীম মজুমদার-এর হাতে।
এক বিকেলে প্যারামাউন্ট-এ……
আমাদের এখানে গরম থাকে আট মাস। তাই গরমে প্যারামাউন্টের বিখ্যাত ডাবের শরবত খেয়ে আসুন, বিশ্বাস করুন সেঞ্চুরি নট আউট এই শরবতে স্বাদ অন্যরকম। সাথে রয়েছে আলাদা এক নস্টালজিয়া। অনেকেই বলতে পারেন ডাবের শরবতের কথা কোনো দিন শুনিনি। তাই কলেজ স্ট্রিটের মহাবোধি সোসাইটির সামনে প্যারামাউন্ট শরবতের দোকান আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে। আপনিও স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের সাথে নিউ মার্কেটে পুজোর শপিং করে ক্লান্ত হয়ে গেল নো চিন্তা, ঘুরে আসুন প্যারামাউন্ট থেকে। এখানে মোটামুটি চল্লিশ জন বসার স্থান রয়েছে। আশা করি তাতে তেমন কোনও অসুবিধা হবে না। ক্যাশবাক্সের দেওয়ালের উপরেই রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা নীরাঞ্জন মজুমদারের ছবি। আরেক দিকের দেওয়ালে নামিদামি লোকদের নামের তালিকা, যারা এখানে এসেছিলেন। যদি ডাবে মন না ভরে তাহলে লিচুর শরবতও অর্ডার করতেই পারেন। ডাবের শরবত খেয়ে সত্যি তাক লেগে যাবেই। অনেককেই দোকান থেকে বাইরে আসার সময় বলতে শুনেছি, আহা! কী খেলাম! ডাবের জলের এ কী স্বাদ! আসল গল্পটা হল এখানকার ডাবের শরবতটির ফর্মুলা দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
নানারঙের ও স্বাদের শরবত…
প্যারামাউন্টে প্রায় চল্লিশটি সিটের মতোই রয়েছে চল্লিশ রকমের শরবত। এই সংস্থা এখন আসলে একটি ব্রান্ড। নানা বিয়ে বা অনুষ্ঠানা বাড়িতে শরবত সরবরাহও করে। এখানকার উল্লেখযোগ্য শরবত হচ্ছে— পাইনঅ্যাপেল মালাই, ডাব শরবত, কোকো মালাই, ক্রিমরোজ, ম্যাঙ্গো ম্যানিয়া, লেমন সিরাপ, লিচুর শরবত, খাস সিরাপ, গ্রিন ম্যাঙ্গো, আঙুর শরবত প্রভৃতি। তবে এক গ্লাসের দাম হল ৪০ থেকে ১২০ টাকা মধ্যে।