পথ ---- ৭
---------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
মা আমার পড়া কিছুই বুঝত না। রাতের খাবার খেতে চাইলে বলতো, " আর চারটে
পাতা পড়ে নে, খেতে দিচ্ছি।" বলার জন্য বলতো না। ভীষণভাবে খেয়াল রাখতো। পড়ার
বই পড়ছি কিনা দেখতো। এই কঠিন পাহারার মাঝে কিভাবে যে গল্পের বই পড়তাম তা
কেবল আমিই জানি। মা একবার আমার কাছ থেকে উঠে গেলেই হল --- ব্যাস, সাথে সাথে
পড়ার বইয়ের জায়গায় গল্পের বই চলে আসত। পুনরায় মা না আসা পর্যন্ত গোগ্রাসে
গিলতাম।
চারপাতা কখন পড়া হয়ে গেছে। এবার যখন খাওয়ার কথা বলতে যেতাম তখন মা
বলতো, " খালি খাওয়া আর খাওয়া। পড় না মন দিয়ে। দিচ্ছি খেতে। " এর মানে হল
এখন খাওয়া নয়। পড়া চালিয়ে যাওয়া।
আসলে বাবা দোকান থেকে না আসা পর্যন্ত আমি কিছুতেই ভাত পাবো না। বাবার
দোকান থেকে ফেরা তো ন'টা দশটায় নয়। রাত বারোটা বেজে গেছে। আমি পড়ছি। ঘড়ির
কাঁটা সাড়ে বারোটা ছুঁই ছুঁই। মা বললো, " একবার এগিয়ে দ্যাখ তো। " তার মানে
সাড়ে বারোটা বেজে গেছে, বাবা এখনও বাড়ি আসে নি। আমাকে এখন হ্যারিকেন নিয়ে
রাস্তায় বের হতে হবে। বেরোতে যাবো এমন সময় শুনতে পেলাম টিউব কল টেপার শব্দ।
আমাদের বাড়ির কাছেই একটা কল ছিল। বাবা ওই কলে হাত পা ধুয়ে তবে বাড়ি ঢুকতো।
তাই বুঝতে পারলাম বাবা আসছে।
বাবার আসতে দেরি হচ্ছে, মানে বাড়িতে একটা চিন্তার পরিবেশ তা কিন্তু নয়।
বাবা আসা পর্যন্ত দিদি অপেক্ষা করতো না। ও আগেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। শুধু
আমাদের বাড়ি নয়, গোটা পাড়াটায় জেগে থাকতাম শুধু আমরা তিনজন। বাবার দেরি করে
আসাটা রোজকার ব্যাপার। বাবার এই আচরণে মা মাঝে মাঝেই খুব রেগে যেত। বাবার ওপর
আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। তাই মাকে সামলানোর ভার আমার।
আমি দেখতাম অভাব আমাদের নিত্য। এ যাবার নয়। বাবা এই ভাবনায় মোটেই ভাবিত
নয় তা জানতাম। কিন্তু তাকে চারদেয়ালের মাঝে ভীষণ অসহায় দেখাত। তাই ওই বয়সে
তার জন্য কিছু করতে না পারি, সূর্য ডোবার পর থেকে মনে হতো মানুষটা তার নিজের
ছন্দে হেঁটে চলে বেড়াক। আমার কেন জানি না মনে হতো, রাতটুকু বাবার নিজস্ব।
ওখানে যেন আমাদের কোনোদিন থাবা বসাতে না হয়।
রাত প্রায় একটা। হ্যারিকেন নিয়ে পথে নামলাম। চেনা পথ। গভীর রাত।
অন্ধকার। এর পরেই যার আসা উচিত সে হল ভয়। না, শরীরে মনে তার কিছুমাত্র ঠাঁই
ছিল না। চারপাশ এতটাই নিঝুম, অনেক দূরের চটির আওয়াজও পাওয়া যেত। এতরাতে আর
কে আসবে বাবা ছাড়া। কোনো কোনো দিন এগিয়েই চলেছি। বাবার আর দেখা নেই। আমাদের
রাস্তায় একটা স্নানের ঘাট পড়ত। দেখি বাবা ঘাটে বসে আছে। পাশে হ্যারিকেনটা
কমিয়ে রাখা। আমি বাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতাম না। পাশে গিয়ে বসতাম। দেখতাম
বাবা যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। আমি যে এসে বসলাম বাবার খেয়ালই নেই। সম্বিত
ফিরলে বলতো, " চল, বাড়ি যাই। " বাকি রাস্তাটা আমরা দুজনে চুপচাপ পাশাপাশি
হেঁটে আসতাম।
হরিৎ:26/05/2017
Related