পথ ------ ২৫
-------------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্ষার দিনগুলোতে আমার মনের রসায়ন অন্যপথে। বর্ষা মানেই আমার হৃদয় জুড়ে
বসে থাকতো রথ। কারণ রথ ছাড়া বর্ষার কাছ থেকে আমার কিছু পাওয়ার নেই। বর্ষা
আমার কাছে ভীষণ অপছন্দের একটা সময়। কিন্তু রথের ক'টা দিন বর্ষার নেতিবাচক
দিকগুলো মনেই থাকতো না।
রথ বলতেই বঙ্কিমের "রাধারাণী"-র দৌলতে মাহেশের রথের ছবি চোখের সামনে ভেসে
ওঠে। যাদের দৃষ্টি দিগন্ত ছাড়িয়ে গেছে তাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে পুরীর
রথ। কৈশোরে আমার মনে এদের অস্তিত্ব সত্ত্বেও মনপ্রাণ জুড়ে আজও আছে আমার
জন্মভূমির রথ। ধনিয়াখালির (প্রচলিত নাম ধনেখালি ) রথ। তাঁতের শাড়িতে
ধনেখালির জগৎ জোড়া নাম। খুব একটা কম খ্যাতি নেই রথেতে। প্রায় দু'শ বছরের
পুরোনো।
অন্তত দিন দশেক আগে থাকতেই আমাদের মনে হতো রথ আসছে। বারোয়ারীতলা আমাদের
বাড়ি থেকে হেঁটে দশ মিনিটের পথ। জায়গাটা মদনমোহনতলা। সারাদিনে অনেকবার যেতাম।
কারণ ওইদিকেই আমাদের স্কুল। যতবার যাই ততবারই দেখি বারোয়ারীর ঘরের মাথার টিনের
ছাউনিতে নতুন টিন লাগাচ্ছে। ঘরগুলো রঙ করছে। এইভাবেই আস্তে আস্তে এগিয়ে আসত
রথ। রোজকার অভাব যন্ত্রণার মধ্যে একটু অন্যরকম হাওয়া।
একমাস আগে থাকতেই পয়সা জমাতাম। যদিও আজকের ছেলেমেয়েদের মতো পয়সা আমরা
স্বপ্নেও কখনও দেখিনি। দু' চারদিন অন্তর দশ কুড়ি পয়সা হাতে পেতাম। তখন পয়সা
কোথায়? বাড়িতে ভীষণই অভাব। একমাসে খুব বেশি হলে টাকা দু'য়েক জমাতে পারতাম।
সোজা রথের দিন পেতাম মেজ জেঠিমার পঁয়তাল্লিশ পয়সা আর ছোট্ ঠাকুমার পঞ্চাশ
পয়সা। সোজা রথের এই প্রাপ্তিযোগ আমাকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে দিত।
মেলায় নিজের হাতে কেনা চিনামাটির হাঁস, মাটির পুতুল, ঘাড় নাড়া বুড়ো
----- কখনও বিছানার ওপর, কখনও মাটির দুয়ারে, কখনও আবার জানলায় সাজিয়ে রাখতাম।
আর দেখতাম কিভাবে এরা আমার দুঃখগুলো মুছিয়ে দেয়। হ্যাঁ, আজও দেয়। বৃষ্টিদিনে
সময় পেলেই এদের সাজাই। বর্ষাদিনে বৃষ্টিগান শুরু হলেই আমার নাকে আজও ভেসে আসে
পাঁপড় ভাজা, ফুলুড়ি, গরম জিলিপির গন্ধ। কানে আসে তালপাতার বাঁশি, বাঁশের
বাঁশির আওয়াজ। এগুলো আজও আমার কাছে বর্ষার আবহসঙ্গীত।
হরিৎঃ২৫/০৬/২০১৭
********************
Related