অরিজিৎ রায় চৌধুরীঃ“জঙ্গল কে রাস্তে সে ট্রেক করনা হ্যায় তো এক্সট্রা প্যায়সা লাগেগা। পারমিশান কে লিয়ে আউর গাইড কে লিয়ে ।রাস্তা ভি লাম্বা হ্যায়। আপ চল পাওগে?” সন্দেহ প্রকাশ নেগি র।
বাঙালির আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলে খুব কম লোকই পার পেয়েছে।
“ কিউ নেহি চল পায়েঙ্গে? আপ কো কেয়া প্রবলেম হ্যায় নেগি জি? এক্সট্রা প্যায়সা জো লাগেগা ও দে দেঙ্গে। আপ ইন্তেজাম কিজিয়ে জলদি সে। ট্রেক করনে আয়ে হ্যায় গাড়ি মে ঘুমনে কে লিয়ে নেহি” রাগত স্বর আমাদের।
গজ গজ করতে করতে নেগি চলে গেলো গাইড এর খোঁজ করতে। গ্রাম থেকেই কাউকে পেয়ে যাবে হয়ত। যাওয়ার আগে বলে গেলো আমরা যেন দেওরিয়াতাল এর পথে এগিয়ে যাই। আমাদের তাল এর পাশে ক্যাম্প করার কথা এমনিতেই । কাল ভোরে গাইড পৌঁছে যাবে তাল এ। সকাল ৭ টার মধ্যে চোপতা র জন্য বেরিয়ে না পরলে পথেই অন্ধকার হয়ে যাবে তখন মুস্কিলে পরব আমরা। গাইড পাওয়া না গেলে ও নিজেই যাবে আমাদের সাথে এটাও জানিয়ে দিল।
আমরা স্যাক পিঠে নিয়ে বেরিয়ে পরার উদ্যোগ নিলাম। কুনাল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধার্মিক মানুষ। কখনও কৃষ্ণ কখনও কালী কখনও দুর্গার বশে থাকে।এবার যে মহাদেব ভর করবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ও একটা রুদ্রাক্ষের মালা বের করে বলল শিব এর নাম জপ করতে করতে হাঁটবে। আমাদের সমবেত হাসি আর কুনাল এর “ভোলে বাবা পার করেগা” হুঙ্কার দিয়ে শুরু হোল প্রথম দিনের ট্রেক।
আমাদের এবারের সফর এর পরমক্ষণ হোল চন্দ্রশীলা পাহাড় এর চূড়া থেকে সূর্যোদয় এর সময় গাড়ওাল হিমালয় পর্বতমালার ৩৬০ ডিগ্রি প্যানরামা। ১৩২০০ ফিট উচ্চতা চন্দ্রশীলার। তিন দিন পর কোজাগরী পূর্ণিমা।সেইদিন ভোর রাতে আমাদের তুঙ্গনাথ থেকে চন্দ্রশীলা এ ওঠার কথা। একটা সাংঘাতিক সুন্দর অভিজ্ঞতার আশায় আছি। তার আগে আমাদের এক রাত্রি দেওরিয়াতাল এ ক্যাম্প, পরের দিন ১৬ কিমি. ট্রেক করে চোপতা।তার পরেরদিন চোপতা থেকে তুঙ্গনাথ। পরেরদিন ভোর এ চন্দ্রশীলা থেকে সূর্যোদয় দেখে সটান চোপতা এ ফেরা। সেদিনই গাড়ি ভাড়া করে রুদ্রপ্রয়াগ। রুদ্রপ্রয়াগ এ এক রাত্রি থেকে পরের দিন হরিদ্বার থেকে হাওড়া র ট্রেন। এই মোটামুটি আমাদের সূচি।
একটি তোরণ আর তাতে হিন্দি তে কেদারনাথ বন্য প্রাণী বিভাগ এর ‘স্বাগতম’ লেখা দেওরিয়া তাল এর পথ নির্দেশ করছে।পথ এর শুরুর দিকে পাথর এর উঁচু উঁচু সিঁড়ি। মালবাহী টাট্টু ঘোড়ার বিষ্ঠায় ভরা। দুর্গন্ধ আর পিছল অতিক্রম করে কিছুটা যাওয়ার পর গ্রাম শেষ হয়ে এলো। এবার রাস্তা পাথর ফেলে বানানো।দুজন কোনরকমে পাশাপাশি হাঁটতে পারে এরকম চওড়া। চড়াই বেশ ভালোই। যে পাহাড়ে র গা কেটে এই রাস্তা বানানো সেই পাহাড়ের ওপর রয়েছে দেওরিয়া তাল।
সন্দীপ নিয়মিত ফুটবল খেলে আর দেবরঞ্জন এর পাহাড়ে ঘোরাঘুরির অভ্যেস আছে। ওদের পা এর জোর আর ফুসফুস এ দম ধরে রাখার ক্ষমতা বেশি। ওরা বেশ কিছুটা আগে আগে চলছে। কুনাল এর হাল্কা শরীর। ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে জপ করতে করতে। স্তিতধী মাঝে আর সবার পিছনে আমি আর দিব্যেন্দু।কিছুটা হাঁটার পর একটু করে দাড়িয়ে পরছি দম নেওয়ার জন্য। আধ ঘণ্টা ওঠার পর নিচে খাদ এর গায়ে সারী গ্রাম এর পুরোটা এক সাথে দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে এই ছোট্ট জনপদ উপর থেকে আরও সুন্দর লাগছে। সারী গ্রাম ছাড়িয়ে খাদ নেমে গেছে অনেকটা। খাদ এর ওপারে আবার পাহাড়ের সারি। সেই সারিবদ্ধ পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ চন্দ্রশীলা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। ক্যামেরা এ জুম করে তুঙ্গনাথ এর মন্দিরও দেখতে পেলাম চন্দ্রশীলা শিখর এর কিছুটা নিচে।
মন্দির এরও কিছুটা নিচে ট্রি লাইন। বাতাসে অক্সিজেন এর পরিমান কম থাকায় ট্রি লাইন এর উপরে গাছ হয় না। দুরের ওই পাহাড়ের চূড়ায় উঠবো আমরা আর তিন দিন পরেই, ভেবেই রোমাঞ্চিত রীতিমত।
আরও কিছুটা ওঠার পর পাহাড়ের গায়ে একটা মন্দির দেখা গেলো। লালমোহন বাবু থাকলে নির্ঘাত বলতেন “এরা তো পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে একটা করে মন্দির বানিয়ে রেখেছে মশাই”।স্থানীয় একজন নিচে নামছিলেন।তার কথা অনুযায়ী এটা “ওঙকার রত্নেশ্বর মাহাদেব” মন্দির। নাগ দেবতাকে উৎসর্গ করা। মন্দির এর স্তাপত্য কেদারনাথ, তুঙ্গনাথ এর মন্দির এর আদলে। মন্দির এর মূল দ্বার তুঙ্গনাথ মন্দির এর অভিমুখে।শিবলিঙ্গ কে একটি সাপ জরিয়ে আছে এরকম মূর্তি আছে নাকি গর্ভগৃহে। নাগ দেবতা ঠাণ্ডায় শীত ঘুম দিচ্ছেন নির্ঘাত, বাকি রাও অনেক এগিয়ে গেছে। দেরী না করে আমরাও ওঠা শুরু করলাম। ঘণ্টা দেড়েক চড়াই ওঠার পর কয়েকজন বিদেশিনী মহিলাদের দেখলাম নেমে আসছেন। কিছুটা দম নেওয়া দরকার তাই খেজুরে আলাপ জুরে দিলাম। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা দলটি আজি ভোরে দেওরিয়াতাল এর উদ্দ্যেশে বেরিয়েছিল। ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে এখন নেমে যাচ্ছে। ওদের পরের গন্ত্যব্য কেদারনাথ। আজই উখিমঠ হয়ে গৌরীকুণ্ড পৌঁছে যাওয়ার প্ল্যান।
“হাউ ইজ দা ভিউ আপ দেয়ার?” আমার প্রশ্ন।
“ওহ ইটস অসাম। বাট ইউ গাইস মাস্ট হারি। উই স ক্লাউডস ওভার দা মাউনটেনস। ইউ উইল মিস দা ভিউ।
ডোন্ট ওরী। উই হ্যাভ টাইম। উই উইল বি ক্যাম্পিং দেয়ার টু নাইট।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে ‘অল দা বেস্ট’ জানিয়ে দলটি নিচে নেমে গেলো।
আমরা আবার ওঠা শুরু করলাম। রাস্তার ধারে রোডোডেণড্রন আর ওক গাছের জঙ্গল। মার্চ এপ্রিল মাসে লাল রোডোডেণড্রন ফুলের আগুন লাগে পথের ধারে, আর ঝরে পরা ফুল যেন গালিচা বিছিয়ে দেয় রুক্ষ পাথর এর উপর। এ দৃশ্য অক্টোবর মাসে শুধু কল্পনাতেই দেখা সম্ভব। আরও ঘণ্টা খানেক চড়াই এর পর একটা বাঁক এর মুখে চোখে পড়লো দোকান টা। পোটাটো চিপস এর রঙ বেরঙ এর একগাদা প্যাকেট ঝুলিয়ে সবুজের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য কে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। খবর নিয়ে দেখলাম এটাই নেগির সাগরেদ এর দোকান।দোকানের পাসেই একটা বাঁধানো চাতাল এর উপর দুটো তাঁবু খাটানো আছে।গন্তব্যে পৌঁছেছি বুঝলাম, কিন্তু দলের আর কারুর দেখা নেই কেন? তালটাই বা কোথায়? দোকানদার একটি অল্প বয়সী ছেলে। বলল আরেকটু এগোলেই তাল চোখে পড়বে। আমাদের সঙ্গীরা নাকি ওখানেই আছে। স্যাক নামিয়ে রেখে এগিয়ে গেলাম। এবার পথ কিছুটা ঢালু হয়ে নিচের দিকে গেছে।সেই দিকে একটু এগোতেই রাস্তার দু ধারের বন পরিষ্কার হয়ে গিয়ে একটা খোলা জায়গায় এসে পড়লাম।
ঢেউ খেলানো বুগিয়াল (গাড়োয়ালি ভাষা এ তৃণভূমি কে বুগিয়াল বলে) সাজিয়ে অপার্থিব সুন্দর দেওরিয়াতাল আমাদের সামনে সবে মাত্র আত্মপ্রকাশ করেছে।মুখ থেকে অজান্তেই “বাহ” বের হয়ে যায় এত সুন্দর এই জায়গাটা। দলের বাকি চারজন দেখলাম বুগিয়াল এর উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। কারুর মুখে কথা নেই। সবাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এমন অসাধারন দৃষ্টান্তে কথা হারিয়েছে। আমাদের ও একই অবস্থা। তাল টা যে খুব একটা বড় তা নয়। একটা বড় সর পুকুর এর মতন। কিন্তু সৌন্দর্য অপরিসীম।টলটল করছে জল।আশেপাশের গাছ গাছালির ঘন সবুজ প্রতিফলন পরেছে জলে।
দেওরিতালের জলের উৎস একটা রহস্যের বিষয়। কোনও নদী, ঝোরা বা হিমবাহের সাথে যোগাযোগ নেই এর। অথচ সারা বছর জলে টইটুম্বুর থাকে। সারী, মাস্তুরা গ্রামের জলের যোগান এই তাল থেকেই আসে।তাল এর গভীরতাও মাপা সম্ভব হয় নি কারন এর তল পাওয়া যায়নি। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৮০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই তালে পৌছতে আমাদের ১৬০০ ফিট উঠতে হয়েছে পায়ে হেঁটে। যেটুকু কষ্ট হয়েছে তাল এর প্রথম দর্শনেই তার উপশম হয়েছে। তালের ব্যাকড্রপে পাহাড়ের সারি মেঘে ঢাকা। গাড়োয়াল হিমালয় এর গঙ্গোত্রী শাখার প্রধান শৃঙ্গ চৌখাম্বা। চারটি শৃঙ্গ চৌখাম্বার। দেখতে আমাদের মোলার টিথ বা পেষক দন্তের আকারের। সবচেয়ে উঁচু চৌখাম্বা – I (২৩,৪১৯ ফুট)। যদিও চারিদিক রোদে ঝলমল করছে, পাহাড়ের উপর থেকে মেঘের আস্তরণ সরার নাম নেই। চৌখাম্বার দর্শন পেতে ধৈর্য ধরতে হবে বোঝা গেলো। দেওরিতাল এর সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে আমরা তালের পাশে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ।
দোকানটায় ফিরে এসে গরম গরম নুডলস দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে আবার গিয়ে বসলাম বুগিয়াল এর উপর। সূর্যাস্তের সময় সোনালি আলো মাখা পাহাড়ের দল কয়েক সেকেন্ড এর জন্য মুখ দেখিয়ে আবার মেঘের আড়ালে চলে গেলো।দেওরিয়াতাল, চৌখাম্বা, দেওরিয়াতালে চৌখাম্বার প্রতিফলন এসব একসাথে দেখা না পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনা। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। আজ আর আশা নেই মনে হচ্ছে। একটা আলো আধারি খেলা করছে তাল এর আনাচে কানাচে।গোধূলির আলোতে সব কিছু যেন মায়াময় হয়ে ওঠে, সে মানুষ ই হোক বা প্রকৃতি। তাল এর পাশে বন বিভাগ এর একটা গুমটি ঘর দেখেছিলাম। সেটার মধ্যে একজন উর্দি পরা আধিকারিক ও ছিলেন সেটা এখন বুঝলাম। অন্ধকার হয়ে আসছে তাও আমরা এখানে বসে আছি দেখে উনি এগিয়ে এসেছেন।
“জ্যাদা দের তাক মাত বৈঁঠিয়ে ইয়াহা। জঙ্গল সে কাভি কাভি লেপার্ড আউর ভালু নিকাল আতা হ্যায় পানি পিনে কে লিয়ে।”
আমাদের একটা ইচ্ছা ছিল রাতে তাল এ পাশে এসে বসবো। ইনি যদি এখনি এমন ভয় দেখান, রাতে নিশ্চয়ই এখানে বসার অনুমতি দেবেন না। আমরা খোশ গল্প শুরু করলাম ওনার সাথে। যদি চিড়ে ভেজান যায়। আমরা জানতাম এক বছর আগেও তাল এর পাশে বুগিয়াল এ তাঁবু খাটিয়ে থাকা যেত। উত্তরাখণ্ড সরকার এখন সেটা নিষিদ্ধ করেছে বুগিয়াল এর ক্ষতি আটকাতে। সেই দিয়েই গল্প শুরু করা গেল। একথা সেকথার পর কুনাল জন্তু জানোয়ার এর প্রসঙ্গ তুলল। স্তিতধী একটা সিগারেট অফার করার পর গল্পটা আরও জমল। ভদ্রলোক এর কথা অনুযায়ী জঙ্গল এ লেপার্ড বা চিতা বেশ কিছু আছে কিন্তু তারা কেউ “ম্যান ইটার” নয়। চিতা নাকি মানুষ কে ভয়ই পায়। খুব নিরুপায় না হলে বা খুব ভয় না পেলে আক্রমণ করে না। ভাল্লুকের ব্যাপারটা অন্য। ভাল্লুক কিন্তু মানুষ দেখলেই আক্রমণ এ উদ্যত হয়। ভাল্লুক মানুষখেকো না হলেও প্রাণে মেরে ফেলে। ভয় ভাল্লুক কেই বেশি। যাই হোক, যে খবর টা সবচেয়ে ভালো লাগলো সেটা হোল বন বিভাগের এই অফিসারটি রাতে এখানে থাকেন না। সারী গ্রাম এই বাস এনার। একটু পরেই উনি নেমে যাবেন আবার ভোর ভোর চলে আসবেন ডিউটি তে।নিশ্চিন্ত হলাম যে রাতে খবরদারি করার কেউ নেই। উনি আমাদের জঙ্গলের দিকে অন্ধকারে না যাওয়ার উপদেশ দিয়ে বিদায় নিলেন। আমরা ঠিক করলাম একটু বেশি রাতে একবার তালের ধারে এসে বসা যাবে।চাঁদনি রাতে বরফ ঢাকা পাহাড়ের সারি কল্পনা করেই একটা উত্তেজনা হচ্ছে। ভাল্লুকের ভয় টা রয়ে যাচ্ছে ঠিকই। ঠিক হোল সবাই টর্চ আর ট্রেকিং পোল হাতে রাখবে। ট্রেকিং পোল এর সমবেত খোঁচায় ভালু বাবাজিকে কাবু করা যাবে এরকম একটা যুক্তি খাড়া করে নিলাম। অন্ধকার নেমেছে। ঠাণ্ডা টাও জাঁকিয়ে পড়ছে। আমরা তাঁবুর দিকে হাঁটা লাগালাম।
ক্রমশঃ