গোধূলির পরে শহরতলি
নীল অভিজিৎ
হয়তো পুরানো কোন কথা হটাৎ কখন মনের ভিতরে প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে, আর সেরকম কোন স্মৃতি বার বার আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল… কাজও নেই কোন, অফিসের ট্যুরে কোলকাতায়, সব কাজ শেষ করে ফেলেছি , মাঝের এই একটা দিন বিশ্রাম, আগামীকাল ফিরে যাব দিল্লী… আজকাল যত সমস্যা হয় কাজের মধ্যে না ডুবে থাকলে।
মনের অনুসরণে হাটি হাটি করে শেষ বিকেলে সেই মানিকতলার কলিমুদ্দিন লেন এসে হটাৎ থমকে দাঁড়াই, এখানে আসার আগে একটু খোঁজ নিয়ে এলেই ভালো হত । চিন্তা করে জিজ্ঞাসা করলাম, রেশন দোকানের পাশে একটা রেডিও দোকানও ছিল, সামনে রাস্তায় জনা কয়েক লোক বলল কোন রেডিও দোকান নেই এখানে, সরু গলিটার শেষ মাথায় খালপাড়া সেখানে একটা টিভির দোকান আছে, ওখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারেন ।
বেশ মনে আছে সেই রেডিও দোকানের পাশ দিয়ে পুরানো গ্যারেজের সামনের মাঠটা এখন তো স্বপ্নে আসে… কই তার চিহ্ন টুকু নেই এখানে… মাঠটা শেষ করে একটা বড় জামগাছ ছিল তারপাশে রোয়াক বাঁধান সিঁড়ি ওয়ালা পুরান বড় দোতলা কমলা রঙের বাড়িটা কি যেন নামটা… নীহারিকা! হ্যাঁ ঠিক নীহারিকাই, এদিক দিয়ে কত বার এসেছি গিয়েছি, আর ওই রোয়াকে বসে কত আড্ডাই না মেরেছি। ।
কিন্তু কোথায় সেই পুরান দোতলা কমলা রঙের বাড়ি নীহারিকা? নেই তো কিছুই ! সেজায়গায় দাঁড়িয়ে কুড়িতলা পঞ্চাশ ফ্ল্যাট বিশিষ্ট “সবুজ-প্রাকৃতি” দাঁড়িয়ে ! কিন্তু কয় তলায় গিয়ে কাকে জিজ্ঞাসা করব যে তিন দশক আগে এই শহরতলিতে আমাদের ইংরাজি পড়াতেন প্রবোধবাবুকে জানেন? আর তার ছোট মেয়ে পিকু?
আমার প্রথম প্রেম আর প্রত্যাখ্যান, যখন আমি প্রেম নিবেদন করি তখন পিকু প্রেসিডেন্সী কলেজের লেকচারার আমাদের থেকে সিনিয়ার রূপকদার সাথে চুটিয়ে প্রেম করত, ইস্ ব্যাপারটা সঠিক জানতাম না, বুকের মধ্যে একটা চাপা ব্যথা নিয়ে পুরো একটা মাস আমি ভিন্ন জগতে ছিলাম, আজও সে কথা পরিষ্কার মনে পড়ে । কিন্তু পিকু তো আমার বাল্যবন্ধু ছিল, সেই ছোটবেলা নার্সারিস্কুল থেকে, আশ্চর্য মেয়েরা ভিতরের কথা কি সুন্দর চাপতে পারে ! তারপর অনেক বছর কেটে গেছে যখন আমি যাদবপুর থেকে সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে জি-কে-ডাবলুতে ট্রেনী, অফিস ফেরতা এক রাতে পাড়ার গলিতে আমাকে ডেকে পিকু বলেছিল… দেখ অনি, আমি একটা বিরাট ভুল করেছি আমাকে ক্ষমা করিস, আমি না জেনে শুনে রূপকদার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম উনি বিবাহিত স্বত্তেও, কেমন যেন উন্মাদনায় ভেসে গেছিলাম। সেদিন তোর করুন মুখটা আজও আমার মনে পড়ে। অনি আমি সত্যি তোকে ভালোবাসি, আমাকে ক্ষমা করবি? হটাৎ কেন যে জ্বলে উঠে ছিলাম শান্ত প্রকৃতির আমি, তা নিজেই জানিনা । ওকে বাড়ি অবধি ছেড়ে দিয়ে উত্তরটা দিয়ে ছিলাম… নারে এখন আমি এনগ্যেইজড মানে বাগদত্ত । নেহাতই ডাহা মিথ্যা বলেছিলাম, হয়তো মনের প্রতি হিংসার জ্বলুনিটায় একটু মলম দাওয়ার চেষ্ঠা করেছিলাম । কিন্তু বুকের ব্যথাটা প্রশমিত করতে পারিনি । বুকের সেই চিনচিনে ব্যথাটা আজ আবার অনুভব করলাম ।
পিকুকে কেউ চেনেনা শহরতলির এই নতুন পাড়ায় । কেমন আছে সেই পিকু ?
কতক্ষণ জানি না সে জায়গাটায় আমি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন দিনের আলো শেষ, চারদিকে অন্ধকার দেখছিলাম, সে সময় হয়তো লোডশেডিং হয়েছিল, অন্ধকারে আমি হাতড়াচ্ছিলাম ৩০ বছরের কোন এক পুরানো স্মৃতিকে শহরতলির সেই গলিটায়।
~ নীল অভিজিৎ:30/06/2017