পথ --- ৩
-------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
"আমার বাংলা"-য় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, "শীতের হাওয়া দিলে আজও
দাফা-র কথা মনে পড়ে।" এরকম কথা আগে কখনও পড়ি নি। কিছু খেলে কারও কথা মনে
পড়ে জানি। বাবা বলতো, "যজমান বাড়িতে যখন কিছু খাই তখন তোর মুখটা খুব মনে
পড়ে। সঙ্গে থাকলে তুইও অমন খেতে পেতিস।" কোনো কিছুর গন্ধে কারও কথা মনে পড়ে।
কিছু দেখলে কারও কথা মনে তো পড়েই। কিন্তু হাওয়ায় কারও কথা মনে পড়ে? যদিও
এখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'হাওয়া' মানে শুধু বাতাসেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি। শীতের
উপস্থিতির কথা বলাই তার মূল লক্ষ্য। প্রথম যেদিন এটা পড়ি অবশ্যই অবাক
হয়েছিলাম। কিন্তু ভাবতে খুব ভালো লেগেছিল।
আজ এই বয়সে এসে বুঝতে পারি এর সত্যতা কতখানি। মাটির ঘর, খড়ের চালে আমার
শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে। একটা ছোট্ট ঘরে আমরা চারজন থাকতাম। মা দিদি মেঝেতে
শুতো, আর আমি বাবা তক্তাপোষে। ঘরে একটাই ছোটো জানলা। বাইরে মারণঝড় বয়ে গেলেও
জানলা দিয়ে তার লেশমাত্র ঘরে প্রবেশ করতো না। জানলাটা শুধু নামে। বছরের পর
বছর ওইভাবেই কাটিয়েছি। হাতপাখা নেড়ে তো আর ঘুমানো যায় না। তাই ঘুমাতাম ওই
ভয়ঙ্কর গরমেই। প্রায় দিনই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত। ঘুম ভাঙলে বুঝতে পারতাম খুব
গরম করছে। আসলে ভীষণ গরমেই ঘুমটা ভেঙে যেত। সবাই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতাম।
প্রত্যেকের হাতে একটা করে হাতপাখা। ক্লান্ত হয়ে কখনও কখনও মাটিতে শুয়েও
পড়তাম।
রাতে বাইরে বসে এক একদিন খুব বিরক্ত লাগত। নিজেদের আর্থিক অবস্থার জন্য
খুব কষ্টও হতো। অভিমান হতো। জানি না তখন কার ওপরে অভিমান করতাম। এইসময়েও পথ
আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। জৈষ্ঠ্যের দুপুরে সে-ই তো আমাকে প্রথম বলে, "কাউকে
ভালোবাসলে তার সবটুকু নিয়েই তাকে ভালোবাসবে।" পথের কথায় আমার চোখ খুলে যায়।
সত্যিই তো ভালোটাকে তো সবাই চাইবে। কিন্তু খারাপটা? সেটা তো কেউ চাইবে না!
তাছাড়া সমগ্রটা ছাড়া কাউকে তো সম্পূর্ণরূপে অনুভবও করা যায় না।
আজ যখন গ্রীষ্মের ভয়ঙ্কর দাবদাহে ঘামে সারা শরীর স্নান করে যায় তখনও
বিরক্ত হই না। গ্রীষ্মকে গরম ছাড়া আর কী দিয়ে অনুভব করা যেত! বরং আমার শৈশব
কৈশোরের অবস্থার কাছে আমি ভীষণভাবে ঋণী। দারিদ্র্যের জন্যেই তো গ্রীষ্মকে তার
নিজের রূপে অনুভব করতে পেরেছি। আর তার জন্যেই তো পেয়েছি পথকে। এতকিছুর
বিনিময়ে একটু গরম ভোগ করতে পারবো না? তাই আজও গ্রীষ্মের দুপুরকে খোলা মনেই
বুকে জড়াই।
22/05/2017
Related