কালাপাহাড়, রথ আর একটা পথ…
অবন্তিকা সান্যাল
হাজার খানেক বছর ধরে বেঁচে আছে ঘন্ট ক্ষেপি। সাদা শনের মত চুল আর কপালে জ্বলজ্বলে লাল সিঁদুর। ক্ষয়াটে জীর্ণ হাড়ে চামড়া বলে আর কিছুই নেই। কিন্তু তার ঘোলাটে চোখ দুটো যেন একটা মস্ত পৃথিবী। চোখে চোখ রাখলেই অনুভব করা যায় ওই ক্ষেপির ঘোলাটে মণি জোড়া একটা আস্ত টাইম মেশিন। চুম্বকের মত টেনে নেয় ভেতরে। চোখ ফুঁড়ে স্পর্শ করা যায় প্রাগৈতিহাসিক রূপকথাদের। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে লেডিস গল্ফ ক্লাবের মাঠে এক পিপুল গাছের নীচে শুয়ে বসে বাস এই ক্ষেপির। সর্বদা পাশে শুয়ে থাকে তার কঙ্কালসার স্বামী।
লোকে বলে বুড়ো স্বামী কে কাঁধে চাপিয়ে, পায়ে হেঁটে সে নাকি ভূভারত ঘোরে। কোথায় না কোথায় চলে যায় মাসের পর মাস। আর তার ইতিহাস? কেউ জানেনা। জানবেই বা কি করে? তার ইতিহাস বলার মত কেউ কি আর বেঁচে আছে নাকি? এক যুগ যায় কিছু লোক মরে। আরো কিছু যুগ যায় আরো কেউ মরে। সবাই ফুরোয় কিন্তু ঘন্ট ক্ষেপি আর তার অতিবৃদ্ধ কৃকলাস দর্শন স্বামী অবতারের কোনো শেষ নেই। তারা দুজনে শুধু দেখে, ওই ঘোলাটে চোখগুলো বিস্ফারিত ক’রে গিলে নেয় সময়, যুগ, মানুষের শরীর থেকে উগরে দেওয়া কালো গনগনে গরল। ক্ষেপির দিন রাত শুধু তার স্বামীকে ঘিরে। অবশ্য প্রাণের বলতে আরেকজন আছে। কালাপাহাড়।
সহজ কথায় কালাপাহাড় এদের অনন্তকালের অভিভাবক। এই কালাপাহাড়ই ঘন্টক্ষেপির আর তার স্বামীর খবর রাখে একমাত্র। হঠাৎ হঠাৎ এসে পরে দেখা করতে তারা যেখানেই থাকুক না কেন। চুপ করে বসে থাকে সঙ্গে। এলোমেলো গল্প করে কতকালের। ঠিক যেন দুটি শিশু, আত্মার আত্মীয়। তাদের ভাষা বোঝা বড়ই কঠিন। তারা যে কোন ভারতের কোন প্রান্তরের বুঝে ওঠাই দায়।
সপ্তাহ কয়েক আগে যখন ক্ষেপিরা অজানা ভ্রমনে বেরিয়েছিল, কালাপাহাড়ের সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয়ে গিয়েছিল জাগারগুণ্ডার পথে। আহ্লাদে আটখানা ঘন্ট ক্ষেপি মোটা করে চা করে খাইয়েছিল কালাপাহাড়কে।
– তু কিমন কালোজাম পরা হোইং গেচিস লয়? ক্ষেপি বলেছিল কালাপাহাড়কে হঠাৎ অনেকদিন পর দেখে। ক্ষেপির মুখে অমন কথা শুনে কালাপাহাড় হাসিতে ফেটে পড়ে। নির্জনতা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। পথের মাঝে চিৎকার করে কালাপাহাড় বলে,
– সবই তোর পিরীতের গুণে রে ক্ষেপি! তারপর আবার যে কে সেই উধাও। মাঝে বেশ কদিন কেটে গেছে। শহরে ফেরার পর আবার দেখা দুই দোসরের পার্কস্ট্রীট আর ময়দানের মাঝামাঝি। পাটভাঙা কাপড় পরে কত্তাগিন্নি যখন ব’সে আছে মেন রাস্তার ধার ঘেঁষে , হঠাৎ করেই না বলে কয়ে কালাপাহাড় এর আগমন। –কি রে ক্ষ্যাপা–ক্ষেপি, আজ জায়গা বদল কেন? কোথাও যাচ্ছিস বুঝি?
উচ্ছসিত হয়ে ক্ষেপি বলে– ধুর! বিষ্টি টো দিখতে ইলাম বড় রাস্তার ধারে। রোজ কি এক জিনিস টো দিখতে ভাল লাগ্যে, তু বল?
উত্তর দেয়না কালাপাহাড়, শুধু চুপ করে শোনে ক্ষেপির কথা তার পাশে ব’সে। শহরের দৈনন্দিন হইচই এর শব্দ ছাপিয়ে আরো হইহই শব্দে কি যেন একটা ঘটছে বেশ কিছু দূর । কালাপাহাড়ের কোনো হেলদোল নেই। সে বড় রাস্তার রেলিঙে হেলান দিয়ে বসে দিব্যি পা নাচাচ্ছে। সেই অজানা শব্দটা কেমন এগিয়ে আসছে একটু একটু করে। ঘন্ট ক্ষেপি ফুটপাথ থেকে নেমে পড়ে রাস্তায়। চেঁচিয়ে বুড়োকে আর কালাপাহাড়কে অবাক হয়ে বলে- কি যেন একটা মিছিল র্যা। বিহ্বল হয়ে চেয়ে দেখে বৃষ্টি ধোয়া রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে একটা বৃহদাকার রঙিন রথ আর তাকে অনুসরণ করে কাতারে কাতারে মানুষ হেঁটে চলেছে খোল করতাল বাজনা বাদ্যি সঙ্গে। রথটা কাছা কাছি আসতেই কালাপাহাড় রেলিঙ টোপকে নেমে পড়ে রাস্তায়। ঘন্টক্ষেপির হাত ধরে টেনে বলে,- ওই দ্যাখ রথ আসছে, আজ রথযাত্রা বুঝলি ক্ষেপি? বুড়ি ক্ষেপি তার কাপড়ের খাটো আঁচলখানা গলায় দিয়ে দুহাত জোড ক’রে কপালে ঠেকায়। কালাপাহাড় বুড়িকে রাস্তার ওপর আরো খানিকটা টেনে আনে। রথটা তখন তাদের বেশ কাছে। কালাপাহাড় ক্ষেপির কাঁধে তার ডান হাত রেখে, বাঁ হাত দিয়ে রথের দিয়ে আঙুল দেখিয়ে বলে- ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ রে বুড়ি! দ্যাখ দিকিনি রথে ওটা কে? ঘণ্ট ক্ষেপি সামনে সামান্য ঝুঁকে মাথাটা তুলে রথের দিকে তাকায়। সেই বিস্ফারিত চোখে রথের ভেতরটা দেখতে দেখতে শিশুর মতো হেসে ফেলে বলে- উ তো তু র্যা কালাপাহাড়! কত্ত কাপড় চোপোড় টো পরিছিস, ফুল পরেছিস কত্তো। বুড়ির এই কথা শুনে কালাপাহাড় হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ে। – কি বলিস রে ঘন্টবুড়ি? তোর চোখ টা একেবারেই গেছে। ও টা জগন্নাথ আর আমি তো তোর কালাপাহাড়!
মরণ! মু ঠিকই দেখি লাই? তু থাম! ই তো সি এক সাজ, যেমন পারা পর্যে তু সমুন্দরের ধার টো তে আমাদের সাথ্যে মিল্যেছিলি? সেই সিবার র্যা, যিবার বুড়ো আর আমি জগন্নাথ দিখবো বল্যে পুরীধাম টো গিলাম অথচ মন্দিরটো বন্ধ ছিল্য বল্যে দেখা হয় লাই। মনে কর তু? স্মরণ লাই তোর?
চুপ করে থাকে কালাপাহাড়, কোনো জবাব দেয়না। খোল করতাল আর কীর্তনে শহরের এ যেন এক অন্য রূপ। হঠাৎ কালাপাহাড় ঘন্টক্ষেপি কে বলে,- এবার তো সামনে থেকে রথ দেখলি, তা, কিছু চাইবি না? আশ কর কিছু একটা জগন্নাথ কে?
হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি ক্ষেপির তখন। ঘোলা চোখে জল ও কেমন যেন অস্পষ্ট। গভীর সমদ্রের রঙের মত। হঠাৎ করেই বলে বসলো ঘন্ট ক্ষেপি, –জানিস কালাপাহাড়, কতদিন ধর্যে তো পরান ডা আছ্যে আমার বল? কত্ত কীই না দিখলাম। শুধু ইকটা কথাই মন্যে আস্যে, ই যো আমার দেশটোর লোগগুলান আছ্যে তারা যেন ইভাবেই দিনের পর দিন টো খেয়ে পর্যে বাঞ্চে। আর যত পরব গুলান আছ্যে, তার উদযাপন, যিমন ধর ইদের জামা, রথের মেল্যা আর বড়দিনটোর কেকগুলান মিশ্যে হোক একডা কল্পতরু।
কালাপাহাড়ের দীর্ঘশ্বাসে এক ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেল চতুর্দিকে। ক্ষেপির দিকে চেয়ে কালাপাহাড় বলে,- এ তো তোর দেশের জন্যে আশ, আর নিজের জন্যে? তোর আর তোর স্বামীর জন্যে?
কোনো কিছু ভাবার দরকার পড়ল না ঘণ্ট ক্ষেপির। বার্ধক্যের সবটুকু উজাড় করে বললো, –তুহার পথ খানা আমাদের দে কালাপাহাড়।
হাসতে হাসতে কালাপাহাড় উঠে পড়ে। এগোতে থাকে একটু একটু করে। তারপর নিমেষে কোথায় যেন মিলিয়ে যায় কালাপাহাড়। এদিক ওদিক তাকিয়ে কালাপাহাড়কে বহু খোঁজার চেষ্টা করে ঘন্টক্ষেপি কিন্তু কোথাও খুঁজে পায়না তাকে। মাটিতে ঝুঁকে পড়ে স্বামী কে তুলে নেয় কাঁধে তার সর্বশক্তি দিয়ে। তারপর পথ চলতে শুরু করে; যে পথ ধরে চলতে চলতে মিলিয়ে গেল কালাপাহাড়
**********************************
অবন্তিকা সান্যাল:25/06/2017